ঈদে শহরের বাসা-বাড়ির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে করনীয়
ঈদে শহরের বাসা-বাড়ির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে করনীয়
বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দাদের প্রতি পুলিশ আহ্বান জানিয়েছে যেন ঈদের ছুটির সময় বাসা-বাড়ির নিরাপত্তায় তারা বাড়তি সতর্কতা নেন। পুলিশের কর্মকর্তা বলেছেন, ঈদের সময় বহু ঢাকাবাসী নগর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে বা বেড়াতে যান। এই সময় ঘরবাড়ি ফাঁকায় থাকায় চুরি-ডাকাতির সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই পুলিশ সদস্যদের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি নগরবাসীকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় চুরি বা ছিনতাই বিরল কোন ঘটনা নয়। কিন্তু ঈদের সময় রাজধানী অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায় বলে এই সময় এ ধরণের অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যায় বলে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন।
সেজন্য নগরবাসীকেও সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
ঈদের ছুটিতে চুরি-ডাকাতির পরিস্থিতি আসলে কতটা গুরুতর?
ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার সময় রাজধানীতে চুরি-ডাকাতি কতটা হয়, সেই পরিসংখ্যান পুলিশের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন একজন মুখপাত্র। কারণ তারা মাসওয়ারি পরিসংখ্যান রাখলেও শুধুমাত্র বিশেষ উৎসবের সময়ের কোন পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করেন না।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রধান কয়েকদিন আগে নগরবাসীকে পরামর্শ দিয়েছেন, ঈদের সময় ফাঁকা থাকায় বাসা-বাড়িতে চুরি ডাকাতি বেড়ে যায়। ফলে নগরবাসী যেন-গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে মূল্যবান জিনিসপত্র, স্বর্ণালঙ্কার আত্মীয়-স্বজনের বাসায় রেখে যান। সেরকম কোন স্বজন না থাকলে প্রয়োজনে নিকটস্থ থানায় জমা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
- থানা মামলা না নেয়া পর্যন্ত 'থামবেন না' পুলিশ সার্জেন্ট মহুয়া হাজং
- থানায় মামলা নিতে অনীহা, ফেসবুকে ভাইরাল হলে পুলিশও তৎপর হয়
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মোঃ ফারুক হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''ছুটিতে বাসা-বাড়ি ফাঁকা থাকলে অপরাধীরা সেই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। যেহেতু ঈদের মতো বড় উৎসবে অনেকে গ্রামের বাড়িতে যান, এই সুযোগে চোররা ফাঁকা বাসায় চুরি করার চেষ্টা চালাতে পারে।''
''আমরা এই সময় অতিরিক্ত সতর্কতা, প্রহরার ব্যবস্থা করি। সব থানাকে বাড়তি টহল দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ঢাকা শহরের সব বাড়িঘর তো তো আর সবসময় পাহারা দিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই নাগরিকের কাছেও আমরা অনুরোধ করি, তারাও যেন নিজেরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।'' তিনি বলছেন।
গত দুই বছরের সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় ঢাকায় মে মাস ও জুলাই মাসে বাসা-বাড়িতে চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনায় তুলনামূলক বেশি মামলা বা সাধারণ ডায়রি দায়ের করা হয়েছে।
২০১৯ সালে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন সোহানা ইয়াসমিন। ঢাকায় ফিরে দেখতে পান, বাসার গ্রিল কেটে কাপড়-চোপড়, দামী জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। ''সব কিছু ভালো করে তালা দিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও জানালার গ্রিল কেটে নিয়ে গেছে। দারোয়ানরাও নাকি টের পায়নি।'' সেই বছরই তিনি বাসা বদলে ফেলেন। ক্ষয়ক্ষতি কম বলে আর থানায় মামলা বা জিডিও করেননি।
পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কয়েকটি নির্দিষ্ট গ্রুপই ঘুরেফিরে এ ধরনের চুরি ডাকাতিতে জড়িত থাকে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিবছর ঈদ বা বড় ছুটির সময় অনেক বাসা ফাঁকা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে চোররা আগে থেকে রেকি করে এসব বাসা চিহ্নিত করে। বিশেষ করে দোতলা বা তিনতলার বাসাগুলো টার্গেট করা হয় বেশি। তদন্তে দেখা গেছে, অনেক সময় বাড়ির নিরাপত্তা কর্মীরাও এসব চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের চুরি না হলে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করতে চান না। ফলে পুলিশও এসব ক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয় না।
পুলিশের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ - কেন অপরাধে জড়ায় তারা?পুলিশের সামনেই কুপিয়ে হত্যার ভিডিও ভাইরাল, পুলিশ কী করলো?মুচলেকা দিয়ে মধ্যরাতে ছাড়া পেলেন মা-ছেলে গত বছরের জুলাই মাসে আট জনকে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। যাদের কাজই ছিল বাসাবাড়ির গ্রিল কেটে চুরি করা। এই চক্রের বিরুদ্ধে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, পিরোজপুরেও মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছিল।
কিন্তু চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধেও কেন পুলিশ আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে পারে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''চুরি-ডাকাতির অপরাধগুলো কিন্তু জামিন যোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ এই অপরাধীরা গ্রেপ্তার হলেও তারা পরবর্তীতে আবার জামিনে বেরিয়ে এসে অপরাধ শুরু করে।''
''কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা হলো, একবার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর পর আর তাদের ওপর নজরদারি বা ফলোআপ করা হয় না। ফলে সেই অপরাধী ঘুরেফিরে আবার অপরাধ করে, বারবার অপরাধ করার সুযোগ পেয়ে যায়। এ কারণে ক্রাইমটা পুরোপুরি বন্ধ হয় না।''
অপরাধ ঠেকাতে কমিউনিটি পুলিশিং-
অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলছেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় এখনো পুলিশের সংখ্যা কম। এক্ষেত্রে অপরাধ দমনে কমিউনিটি পুলিশিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সমাজের নানা পেশার মানুষজনকে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা তৈরি হলে, তারাই নিজেদের চারপাশের এলাকায় নজরদারির ব্যবস্থা করবেন। ফলে অপরাধীরা কোন অপরাধ ঘটানোর সাহস পাবে না। সেখানে প্রয়োজনে নিয়মিত পুলিশ সদস্যরা তাদের সহায়তা করবেন।
"এই ফোরামগুলোকে যদি স্ট্রং করতে পারি, তাহলে কিন্তু অনেকাংশেই অপরাধ কমে আসবে। তবে এসব ফোরামে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেখানে কোন অপরাধের আভাস পেলেই তারা নিয়মিত পুলিশের সহায়তায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে, '' বলছেন অধ্যাপক রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, নাগরিকদের সবরকমের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একজন নাগরিককে তার মূল্যবান সম্পদের নিরাপত্তার জন্য অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে হবে, সেটা কোন যুক্তি হতে পারে না।
তিনি বলছেন, ''নাগরিকদেরও সতর্ক থাকতে হবে, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই তার পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দিতে হবে। সেখানে তাদের দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই।''
''আমি মনে করি, এটা পারস্পরিক একটা বিষয়। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক- উভয়ে মিলেই সতর্কতা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে,'' তিনি বলছেন।
পুলিশের কিছু পরামর্শ-
বাসাবাড়িতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- আপনার বাসা/অফিসে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ব্যবহার করুন
- বাসা/ফ্ল্যাটের মেইন গেটে অটো লক ব্যবহার করুন
- বাসা/বাড়ি ত্যাগের পূর্বে রুমের দরজা-জানালা সঠিকভাবে তালাবন্ধ করুন। যে সমস্ত দরজা-জানালা দুর্বল অবস্থায় আছে তা এখনই মেরামত করে নিন এবং যথাসম্ভব সুরক্ষিত করে নিন। প্রয়োজনে একাধিক তালা ব্যবহার করুন
- রাতে আপনার বাসার চারপাশ আলোকিত করে রাখুন
- আপনার বাসা বা ফ্ল্যাটে সিসিটিভি স্থাপন করুন। সিসিটিভিসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় থাকার বিষয়টি নিয়মিত নিশ্চিত করুন
- দরজায় নিরাপত্তা এলার্মযুক্ত তালা ব্যবহার করুন
- মূল্যবান সামগ্রী ও দলিল নিরাপদ হেফাজতে রাখুন এবং তালাবন্ধ করুন। প্রয়োজনে ব্যাংক লকারের সহায়তা নিতে পারেন
- বাসা/বাড়ি ত্যাগের পূর্বে যে সমস্ত প্রতিবেশী/পাশের ফ্ল্যাটের অধিবাসী ঢাকায় অবস্থান করবেন তাদেরকে আপনার বাসার প্রতি লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ করুন এবং ফোনে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন
- ভাড়াটিয়াগণ পূর্বেই বাসার মালিককে ঈদ উপলক্ষে বাসা ত্যাগের বিষয়টি অবহিত করুন
- মহল্লা ও বাড়ির সামনে সন্দেহজনক কাউকে/দুষ্কৃতিকারীকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাকে অবহিত করুন
- ঈদে আপনার মহল্লা/বাসায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকলে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তা স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশ/থানা/ফাঁড়িকে অবহিত করুন
- বাসার গাড়ির গ্যারেজ সুরক্ষিত করুন
- বাসার জানালা/দরজার পাশে কোন গাছ থাকলে শাখা-প্রশাখা কেটে ফেলুন যাতে অপরাধীরা শাখা-প্রশাখা ব্যবহার করে বাসায় প্রবেশ করতে না পারে।