জন্ম তারিখ দিয়ে জন্ম নিবন্ধন যাচাই ও জন্ম নিবন্ধন সংশোধন

 প্রকাশ: ১৮ অগাস্ট ২০২২, ০৮:০৫ অপরাহ্ন   |   সার্ভিস

জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও জন্ম নিবন্ধন সংশোধন

জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও জন্ম নিবন্ধন সংশোধন

জন্ম সনদ হচ্ছে কোনো মানুষ বা ব্যাক্তির জন্মের পর রাষ্ট্র কতৃক প্রথম স্বীকৃতি। কোনো শিশুর জন্মের পর তার তথ্য আইনগত ভাবে সরকারী খাতায় লেখাই মুলত জন্ম নিবন্ধন।  বাংলাদেশে ২০০৪ সালে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন প্রনয়ন করে সরকার। এই আইন এর মতে ধর্ম,বর্ন,জাতি,গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবারই জন্ম  নিবন্ধন করা বাধ্যতামুলক। কিন্তু আমরা জন্ম নিবন্ধন করার সময় তারাহুরো বা অসাবধানতার কারনে অনেক সময় ভুল করে ফেলি জন্ম সনদে। যেটা অত্যন্ত খারাপ একটি ব্যাপার। এর ফলে জন্ম নিবন্ধন বাতিল ও হয়ে যেতে পারে এমনকি পরবর্তীতে ছোটো বড় অনেক সমস্যায় ই পড়তে হতে পারে। তাই আমাদের সবারই উচিত সঠিক তথ্য দিয়ে জন্ম নিবন্ধন করা। তাই নির্ভুলভাবে জন্ম নিবন্ধন করার কিছু সহজ পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে আজকের ব্লগে।

জন্ম নিবন্ধন এর প্রয়োজনীয়তা 

২০০৪ সালে আইন প্রনয়ন করা হলেও ২০০৬ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। এই আইন অনুযায়ী বর্তমানে কোনো শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করতেই হবে। যদি জন্ম নিবন্ধন করতে দেরি হয় তাহলে শিশুর পিতা মাতা কে জরিমানা ও গুনতে হয়।   বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন থেকে পরিচয়পত্র পাওয়ার আগে কোনো শিশু বা কিশোরের এটিই প্রথম রাষ্ট্রীয় পরিচয়। তাই প্রায় সব যায়গায় ই এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে।

  • জাতিয় পরিচয়পত্র পাওয়ার আগে মানে ১৮ বছর হওয়ার আগে অনেকেরই পাসপোর্ট তৈরি করার প্রয়োজন হয়। তাই আবেদনকারীকে জন্ম সনদ দেখাতে হবে।
  • দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য জন্ম সনদ এর প্রয়োজন হয়। এছাড়াও মাধ্যমিক বোর্ড পরিক্ষা যেমন জে এস সি, এস এস সি পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশন করার সময় জন্ম নিবন্ধন ব্যাবহার করতে হয়।
  •  পাত্র পাত্রীর সঠিক বয়স নির্নয়ের জন্য অবশ্যই জন্ম সনদ ব্যবহার করতে হয়।  এতে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হয়।
  •  আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন ১৮ বছর হওয়ার সাথে সাথেই ড্রাইভিং লাইসেন্স এর প্রয়োজন হয়। কিন্তু জাতিয় পরিচয়পত্র সংগ্রহে থাকে নাহ। এক্ষেত্রে আবেদনকারীকে অবশ্যই জন্ম সনদ দেখিয়ে ড্রাইভিং  লাইসেন্স করতে হবে।
  •  ভোটার আইডি কার্ড এর জন্য নিবন্ধন করতে হলেও আবেদনকারীর জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যবহার করতে হয়।

 

জন্ম নিবন্ধন করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র 

জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য কিছু কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। নিচে তা উল্লেখ করা হলো।

শিশুর জন্মের ৫ বছর এর মাঝে জন্ম নিবন্ধন করানো হলেঃ 

  • শিশুটি যে ক্লিনিক বা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছে তার ছাড়পত্র বা সার্টিফিকেট।
  • যদি কোনো হাসপাতালে জন্ম না হয়ে থাকে তাহলে তথ্য সংগ্রহকারী কোনো এনজিও কর্মীর প্রত্যয়ন পত্র।
  • এটাও যদি না থাকে তাহলে নিবন্ধক এর জন্ম সংক্রান্ত কোন দলিলের সত্যায়িত কপি।
  • পিতা মাতার জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি।

 

শিশুর বয়স ৫ বছর বা তার বেশি হলেঃ 

  • বয়স প্রমান করার জন্য এমবি বি এস ডাক্তারের প্রত্যয়ন।
  • জন্মস্থান প্রমানের জন্য বা স্থায়ী বাসস্থান প্রমানের জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর প্রত্যয়ন পত্র।
  • উপরের কাগজপত্র না পাওয়া গেলে বয়স ও জন্মস্থান প্রমানের জন্য তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ দ্বারা মনোনীত শিক্ষক বা কর্মকর্তার প্রত্যয়ন। অথবা বয়স ও জন্নস্থান প্রমানের জন্য ইপি আই কার্ড বা পাসপোর্ট বা মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের জন্ম সংক্রান্ত ছাড়পত্র বা ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত জন্ম সনদের সত্যায়িত অনুলিপি।  অথবা নিবন্ধকের জন্ম তারিখ বা তার ঠিকানার প্রমান হিসেবে জন্ম সংক্রান্ত কোনো দলিল। বা কোনো এনজিও কর্মীর প্রত্যয়ন।
  •  পিতা মাতার জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি।

বর্তমানে অনলাইনে বা সশরীরে উপস্থিত হয়ে বা অফলাইনে  সব ভাবেই জন্ন সনদের জন্য নিবন্ধন করা যায়। এবার জেনে নেওয়া যাক জন্ম নিবন্ধন করার বিস্তারিত পদ্ধতি।

বিস্তারিত পদ্ধতি 

আমরা জানি ২০০৬ সাল থেকে জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন আইনটি প্রনয়ন হলে ২০১০ পর্যন্ত বিনা মুল্যে জন্ম সনদ পাওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়েছিলো। ওই সময় দেশের অধিকাংশ নাগরিক ই জন্ম নিবন্ধন করে ফেলে। তবে এখন নির্দিষ্ট কিছু অ্যামাওন্ট ফি প্রদান করে জন্ম নিবন্ধন করা হলেও এটি এখন অনেক সহজ একটি প্রক্রিয়া।

সশরীরে জন্ম সনদ তৈরি করার নিয়মঃ 

বাংলাদেশে যখন থেকে জন্ম নিবন্ধন প্রদান শুরু হয় তখন থেকেই সশরীরে ফরম পুরন করে জন্ম নিবন্ধন করতে হতো। এখনো এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। চাইলে এখনো যে কেও এভাবে আবেদন করতে পারবেন।

নির্দিষ্ট কোনো কার্যালয়ে গিয়ে আবেদনকারীকে জন্ম নিবন্ধন তৈরি করার জন্য আবেদন করতে হবে। ফরম তোলা থেকে শুরু করে, ফরম জমা দেওয়া এবং জন্ম সনদ গ্রহন করা সবই ওই কার্যালয় থেকেই করতে পারবেন। কার্যালয়টি অবশ্যই আবেদনকারীর  ঠিকানা অনুসারে হবে। নিম্নোক্ত কার্যালয় হতে পারেঃ

  • ইউনিয়ন পরিষদের কোনো চেয়ারম্যান বা সরকার কতৃক ভারপ্রাপ্ত কোন কর্ম কর্তা।
  • পোরসভা মেয়র বা তার দ্বারা ভারপ্রাপ্ত কোনো কাউন্সিলর।
  • সিটি কর্পারেশন এর কোনো মেয়র বা তার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কাউন্সিলর।
  • ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কোনো প্রেসিডেন্ট অথবা তার দ্বারা ভারপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা।
  • বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দুতাবাসের কোনো রাষ্ট্রদুত।

সশরীরে জন্ম নিবন্ধন করার নিয়মঃ 

প্রথম ধাপ -ঃ ফরম সংগ্রহ করা 


কোনো শিশুর জন্ম নিবন্ধন করার সময় প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ,পৌরসভা কার্যালয়,বা ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

কার্যালয় এ গিয়ে কষ্ট করে নিতে না চাইলে সরকারি ওয়েবসাইট থেকে ফ্রিতে পিডিএফ ফাইল ডাওনলোড করা যাবে।

দ্বিতীয় ধাপ-ঃ ফরম পুরন করা 

ফরম সংগ্রহ করার পর ভালোভাবে দেখে ফরমটি পুরন করতে হবে। 

তৃতীয় ধাপ-ঃ আবেদন ফরম জমা দেওয়া

ফরমটি পুরন করার পর এটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে জমা দিতে হবে। জমা দেওয়ার আগে অবশ্যই প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো ফরমের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।  এরপর কাজ শেষ হলে ঠিকানা অনুযায়ী  চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর,মেয়র এর কার্যালয়ে জমা দিতে হবে।

চতুর্থ ধাপ-ঃ কুপন সংগ্রহ করা

ফরম টি জমা দেওয়ার পর আবেদনকারীকে একটি নির্দিষ্ট তারিখ কুপন আকারে লিখে দিতে হবে। কুপন বলতে ফর্ম এর একটা অংশ যেটাকে নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত অবশ্যই সংগ্রহ করতে হয়।

শেষ ধাপ-ঃ জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করা

আপনার কুপনে যে ডেট দেওয়া থাকবে ওই ডেটে আপনি কার্যালয়ে গিয়ে স্বাক্ষর করে আপনার জন্ম সনদ টি নিতে পারবেন। তবে নেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কর্মকর্তাদের সিল বা স্বাক্ষর সঠিকভাবে আছে কিনা।

অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করার নিয়মঃ

অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে।  সশরীরে করার পাশা পাশি কাজের নির্ভুলতা ও দ্রুততার জন্য অনলাইনে করার কার্যক্রম টি প্রচলিত রয়েছে। নিম্নে ধাপগুলে উল্লেখ করা হলোঃ

ধাপ ১-ঃ অনলাইনে নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে  এইখানে  ক্লিক করুন

ধাপ ২-ঃ ওয়েবসাইট টিতে প্রবেশ করার আবেদন কারী কোন এলাকার কোন কার্যালয় হতে নিতে চায় সেটি নির্বাচন করতে হবে। চাইলে জন্মস্থান বা স্থায়ী ঠিকানা যেকোনো কার্যালয় সিলেক্ট করতে পারবে। যদি দেশের বাইরে হয় তাহলে  বাংলাদেশ দুতাবাস সিলেক্ট করতে হবে। আপনি যে কার্যালয় সিলেক্ট করবেন সেখান থেকেই জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করতে হবে।

ধাপ ৩-ঃ এরপর আবেদনকারীকে একটি ফরম পুরন করতে হবে।

  • ফরমের শুরুতে আবেদনকারীর নাম বাংলায় ও ইংরেজিতে স্পষ্ট ভাবে লিখতে হবে।
  • এরপর জন্ম তারিখ উল্লেখ করতে হবে।
  • এখন সে পিতামাতার কত তম সন্তান ও তার লিঙ্গ সিলেক্ট করতে হবে।
  • শেষে জন্মস্থান লিখতে হবে।

 

ধাপ ৪-ঃ আারেকটি ফরম ওপেন হবে।

  • প্রথমে পিতার জন্ম সনদের নাম্বার এবং নিচে বাংলা ও ইংরেজিতে নাম ভালোভাবে লিখতে হবে।
  • এরপর পিতার জাতিয় পরিচয়পত্রের নাম্বার এবং জাতিয়তা উল্লেখ করতে হবে।
  •  একইভাবে মাতার সকল তথ্যও পুরন করতে হবে।

ধাপ ৫  আপনার স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা দেওয়ার জন্য একরি অপশন চলে আসবে।

ধাপ ৬ আবেদনকারীর ইমেইল ও মোবাইল নম্বর জমা দিতে হবে।

ধাপ ৭-ঃ সকল তথ্য সঠিক থাকলে সমস্যা হওয়ার কথা নয় আপনাকে আপনার প্রদান করা তথ্যগুলো দেখানো হবে। এখান থেকে তথ্য যাচাই করে সংশেধন করে নিন। এবং সাবমিট করুন।

ধাপ ৮-ঃ এরপর আপনাকে একটি পেইজে নিয়ে যাবে যেখান থেকে আপনার আবেদন এর পরিস্থিতি দেখতে পারবেন।

জন্ম নিবন্ধন করার খরচঃ

২০১০ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে করা গেলেও এখন নির্দিষ্ট কিছু ফি দিতে হয়। নিম্নে উল্লেখ করা হলো

 

দেশে আবেদন করলেঃ

জন্মের ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনামূল্যে

৫ বছর পর্যন্ত ২৫  টাকা

৫ বছর শেষ হয়ে গেলে ৫০ টাকা

বিদেশে আবেদন করার ক্ষেত্রেঃ

জন্মের ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনামূল্যে

৫ বছর পর্যন্ত ১ মার্কিন ডলার

জন্মের ৫ বছরের বেশি হয়ে গেলে ১ মার্কিন ডলার

সর্বশেষে জন্ম সনদ নাগরিকের অপরিহার্য একটি ডকুমেন্ট। তাই আমাদের সবারই এটি থাকা উচিত। এবং জন্ম সনদ সহজ ও নির্ভুলভাবে তৈরি করতে আমার লেখাটি আশাকরি অনেক সহায়তা করবে।

এরকম আরে সুন্দর এবং ইনফরমেটিভ ব্লগ পেতে ক্লিক করুন